ত্রাণের জন্য জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের হামলায় সাড়ে আট শতাধিক হতাহত হয়েছেন। শয্যার অভাবে কামাল আদওয়ান হাসপাতালের মেঝেতেই আহতদের চিকিৎসা চলছে। গতকাল উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায়ছবি: এএফপি
ফিলিস্তিনের গাজায় ত্রাণ নিতে জড়ো হওয়া মানুষের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ১১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৬০ জন। খাবারের অভাবে যখন ফিলিস্তিনি শিশুরা মারা যাচ্ছে, এমন সময় গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে এ হামলার ঘটনা ঘটল। এদিকে গাজায় প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে সাড়ে ১২ হাজারই শিশু।
গাজা নগরীর দক্ষিণে আল-রাশিদ স্ট্রিটে ত্রাণের জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন হাজারো ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি। গতকাল ভোরে ত্রাণবাহী ট্রাক আসতে শুরু করলে ছুটে যান তাঁরা। এ সময় তাঁদের ওপর বিমান হামলা ও ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছে ইসরায়েল। দেশটি বলেছে, তারা ঘটনাটি খতিয়ে দেখছে।
আল-রাশিদ স্ট্রিটে হামলার পরপরই
ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ত্রাণ দিতে আসা ট্রাকগুলোকে একপর্যায়ে অ্যাম্বুলেন্সের কাজে ব্যবহার করা হয়। হতাহতদের কামাল আদওয়ান হাসপাতাল ও আল-শিফা হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে একসঙ্গে এত মানুষকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ৩৫ জনে দাঁড়িয়েছে। নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সাড়ে ১২ হাজারই শিশু। আহত হয়েছেন ৭০ হাজারের বেশি।
তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, হাসপাতালে আসা মরদেহ হিসাব করে নিহতের পরিসংখ্যান দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর ও স্থাপনার ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে থাকা কয়েক হাজার মরদেহ এই হিসাবের বাইরে রয়েছে।
‘এ যেন মৃত্যুফাঁদ’
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে অবরুদ্ধ গাজার এক-চতুর্থাংশ মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে এক ধাপ দূরে রয়েছে। গাজার উত্তরাঞ্চলে দুই বছরের কম বয়সী প্রতি ছয় শিশুর একজন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
কিছুদিন ধরে গাজার ক্ষুধার্ত লোকজন ত্রাণবাহী ট্রাক দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। ত্রাণ লুটের ঘটনাও ঘটেছে। ত্রাণের জন্য মরিয়া এমন লোকজনের ওপরই গতকাল হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
ফিলিস্তিনের সংবাদমাধ্যম কুদস নিউজ নেটওয়ার্ককে একজন বলেন, ‘হাতে সামান্য ত্রাণ পেতে আমরা এখানে এসেছি। আমি গতকাল থেকে অপেক্ষা করছিলাম। ভোর সাড়ে চারটার দিকে ত্রাণবাহী ট্রাক আসতে শুরু করে। যখনই আমরা ট্রাকের দিকে এগিয়ে যাই, ইসরায়েলি বাহিনী ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান থেকে আমাদের ওপর হামলা শুরু করে। যেন এটা ছিল একটা ফাঁদ।’
ফিলিস্তিনি এই পুরুষ বলেন, ‘আরব রাষ্ট্রগুলোকে আমি বলছি, আমাদের যদি এভাবে খুন হওয়া তোমরা দেখতে চাও, তাহলে কেন তোমরা ত্রাণ পাঠাচ্ছ? আমরা আর কোনো ত্রাণসহায়তা চাই না। একেকটি ত্রাণবহর আসা মানে আরেকটি হত্যাযজ্ঞ।’
‘ঠান্ডা মাথার হত্যাযজ্ঞ’
গাজায় ত্রাণ নিতে জড়ো হওয়া লোকজনের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলাকে ‘ঠান্ডা মাথার হত্যাযজ্ঞ’ বলে মন্তব্য করেছে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, এই হামলা গাজায় চলমান ইসরায়েলের ‘গণহত্যামূলক যুদ্ধেরই’ অংশ। যুদ্ধবিরতির জন্য জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রণালয় বলেছে, বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় এটাই একমাত্র পথ।
ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা শত শত মানুষের ওপর ইসরায়েলের হামলাকে ‘জঘন্য হত্যাযজ্ঞ ও যুদ্ধাপরাধের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা’ বলে অভিযোগ করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস।
এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, এই হামলা ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত করা এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে মুছে ফেলার ইসরায়েলি প্রচেষ্টারই অংশ। গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ এবং জাতিগত নিধন বন্ধ করতে জরুরি ভিত্তিতে আরব লিগ ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে হামাস।
ক্ষুধা-অপুষ্টিতে ৬ শিশুর মৃত্যু
এদিকে গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে পানিশূন্যতা ও অপুষ্টিতে ভুগে ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
এর মধ্যে আল-শিফা হাসপাতালে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে গত বুধবার জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে গাজার উত্তরাঞ্চলের কামাল আদওয়ান হাসপাতালে আরও চার শিশুর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া সাত শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অবরুদ্ধ গাজার এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার (ওসিএইচএ) উপপ্রধান রমেশ রাজাসিংঘাম বলেছেন, ‘আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি, ফেব্রুয়ারির শেষে এসে গাজায় অন্তত ৫ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে রয়েছে, যা গাজার মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ।’