আজ পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সর্বত্রই ভয়ভীতি আর অশান্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র এবং মানুষকে ধ্বংস করে দেওয়ার অস্ত্র ও মাধ্যম সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।


একজন মানুষ অন্যজনের শত্রু বনে বসে আছে। শক্তিশালী জাতি তার চেয়ে তুলনামূলক দুর্বল জাতির ওপর জুলুম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাস দমনের নামে বৃহৎ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে। এরপর মিডিয়াও ভীতি আর অশান্তির আবহ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি করছে না। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটিই পথ আর তা হলো, পবিত্র কুরআনের শিক্ষার ওপর আমল আর মুসলমানরা যেন নিজেদের আমলের মাধ্যমে ইসলামকে বদনাম করা ছেড়ে দেয়। তারা যেন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় আমল করে এবং পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়।

অন্যান্য জাতিদের কল্যাণও এতেই নিহিত যে, তারা যেন ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়ে যায়, কেননা বিশ্বের শান্তি কেবল প্রকৃত ইসলামের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। বর্তমানে আমাদের বিশ্ব যেসব বড় বড় সমস্যায় জর্জরিত এসব পরিস্থিতিকে যদি এক বাক্যে বলতে হয় তাহলে মৌলিক সমস্যা হলো, শান্তি উঠে যাওয়া আর এটি নিরসনে আজ পর্যন্ত যত চেষ্টা-প্রচেষ্টা করা হয়েছে তা বাহ্যত সবই ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে আর এখন ইউনাটেড ন্যাশন্সকে পর্যুদস্ত মনে হচ্ছে। পুরো মানবজাতি আজ অস্থির, তাদের কখন, কোথা থেকে এবং কীভাবে শান্তি নামের অমূল্য সম্পদ জুটবে। হ্যাঁ, পুরো বিশ্বে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে কিন্তু তা কেবল পবিত্র কুরআনে উপস্থাপিত শিক্ষামালা অবলম্বনের মাধ্যমেই সম্ভব।

কুরআন মজিদ আল্লাহতায়ালার সেই পবিত্র বাণী যা রহমান ও রহিম খোদা অবতীর্ণ করেছেন। আর এটি এক পূর্ণাঙ্গীন ও পরিপূর্ণ এবং স্থায়ী শরিয়ত হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছে, যে বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক নুর এবং উজ্জ্বল কিতাবও। এর মাধ্যমে আল্লাহ সেসব লোককে শান্তির পথে পরিচালিত করেন, যারা তার সন্তুষ্টির পথে চলে। আর তিনি নিজ আদেশে তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং সরল সুদৃঢ় পথে তাদের পরিচালিত করেন’। (সূরা মায়েদা : ১৫-১৬)।

হজরত রাসূল পাক (সা.)-এর কল্যাণমণ্ডিত পুরো জীবন এ বিষয়ের জীবন্ত সাক্ষী, তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার এক মহান মূর্তিমান প্রতীক হিসাবে জীবনযাপন করেছেন এবং চরম প্রতিকূল ও কঠিন পরিস্থিতিতেও শান্তির পতাকা উঁচু রেখে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, কুরআনি শিক্ষামালার ওপর আমল করলে পরই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তার মাক্কি জীবনী এবং মাদানি যুগেও তার পুরো জীবনাদর্শ এমন সব ঘটনাবলিতে পরিপূর্ণ যে, কীভাবে মহানবি (সা.) তার মান্যকারীদের কুরআনের শিক্ষামালার কল্যাণে শান্তির মূর্তিমান প্রতীক বানিয়ে দিয়েছেন।

যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তিনি মুসলমানদের সামনে এক পরম সহানুভূতিপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ উত্তম নৈতিক আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। যুদ্ধের নাম নিলেই তো বর্তমান যুগের নামসর্বস্ব সভ্য দেশগুলো নম্রতা, নৈতিক আচরণ, সহমর্মিতা এবং ন্যায়বিচারের সব দাবি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যায় কিন্তু বিশ্বশান্তির মহানায়ক হজরত মুহাম্মাদ (সা.) যুদ্ধ এবং হানাহানির ক্ষেত্রগুলোয় শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে এমন অতুলনীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন যা সব যুগে পুরো মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।

মক্কা বিজয়ের দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে স্পষ্ট সাক্ষী। তার সব খুনি শত্রুদের ক্ষমা করে বিশ্ব ইতিহাসে সেই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত এর কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে হজরত মহানবি (সা.) সর্বদা এমন আদর্শ দেখিয়েছেন যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

শান্তির অভিযাত্রা এক ব্যক্তি সত্তা থেকে শুরু হয়। এর বীজ মূলত সবচেয়ে প্রথমে মানুষের হৃদয়ে বপন করা হয়। এটি যখন বর্ধিত হয় তখন সেই ব্যক্তির পরিবার শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। এরপর এটি পারিবারিক জীবনকে ছাড়িয়ে শান্তির এ কল্যাণ সমাজে এবং চারপাশে বিস্তার লাভ করে। এর পরবর্তী ধাপ জাতীয় শান্তি ও নিরাপত্তা হয়ে থাকে যা অবশেষে আন্তর্জাতিক শান্তির রূপ ধারণ করে নেয়।

এটি কোনো ধারণাপ্রসূত ও কাল্পনিক ফরমুলা নয় বরং এটি এমনই সত্য যার প্রকাশ পুরো বিশ্বে দৃষ্টিগোচর হয়। কুরআন মজিদ শান্তির বীজ হিসাবে আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বে পূর্ণ ইমান আনাকে উপস্থাপন করেছে। এর স্পষ্ট প্রমাণ হলো, যারা আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বে জীবন্ত ইমান রাখে তারা কখনো অস্থিরতা বা মানসিক চাপের ততটুকু শিকার হয় না যাতে নিজের জীবন সম্পর্কেই নিরাশ হয়ে যেতে হয়। আমরা দেখি সেসব মনোনীত ব্যক্তি যাদের আল্লাহতায়ালা নিজে বেছে নিয়ে নবুয়তের মর্যাদায় ভূষিত করেন তাদের হৃদয়ে এমন শান্তি ও প্রশান্তি ভরে দেন যে, পার্থিব জগতের শত বিরোধিতা এবং বিপদাপদের ঝড়-তুফান সত্ত্বেও তারা সর্বদা আল্লাহতায়ালার আঁচলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ফলে শান্তি ও নিরাপত্তার জান্নাতে জীবন কাটান।

পৃথিবীর ইতিহাসে একজন নবিও এমন অতিবাহিত হননি যিনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাদের হৃদয় সর্বদাস্থায়ী শান্তি ও স্বস্তির আবাসস্থল হয়ে থাকে। তাদের হৃদয়কে আল্লাহতায়ালার প্রতি তাদের দৃঢ় বিশ্বাস এবং তার স্মরণ সর্বদা আলোকিত রাখে। প্রত্যেক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সময় রহিম ও করিম খোদার রহমতের ছায়া তাদের মাথার ওপর বিরাজ করে এবং আল্লাহতায়ালার ক্ষমতাবলে তাদের তত্ত্বাবধান করেন। কুরআন মজিদ এ মৌলিক বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছে, হৃদয়ে প্রকৃত ও সত্যিকারের শান্তি ও স্বস্তি আল্লাহতায়ালার স্মরণেই পাওয়া সম্ভব আর আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করার সম্পদ আল্লাহতায়ালার সত্তায় পূর্ণ ইমান বলেই পাওয়া যায় (সূরা আর রাদ)।

প্রকৃত পক্ষে হৃদয়ে যদি আল্লাহতায়ালার অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে এবং দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয়ে যায় তাহলে এটিই সেই ব্যবস্থাপত্র যা বিশ্ব শান্তির নিশ্চিত ও সত্যিকার মাধ্যম। এ মূলনীতি বর্ণনা করার পাশাপাশি পবিত্র কুরআন বলে, শান্তি ও নিরাপত্তার অভিযাত্রা পরিবার থেকে শুরু হয়। পরিবারগুলোকে শান্তির নীড়ে পরিণত করার জন্য এবং জান্নাত সদৃশ বানানোর জন্য পবিত্র কুরআন পূর্ণাঙ্গ শিক্ষামালা উপস্থাপন করেছে।

শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা হলো, বিশ্বের বিভিন্ন জাতিতে বর্ণের অহংকার ও জাতিগত গর্ব। পবিত্র কুরআন ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও সহিষ্ণুতার এক মূর্তিমান প্রতীক। দেখুন, পবিত্র কুরআনে কত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : ধর্মের ব্যাপারে কোনো বলপ্রয়োগ নেই। কেননা হেদায়েত এবং ভ্রষ্টতার মাঝে পার্থক্য ভালোভাবে স্পষ্ট হয়ে গেছে (সূরা আল বাকারা)।

কত সুন্দর দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তিকে জোর করে ইসলামে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন কী যখন কিনা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব দিব্য-দিবালোকের মতো স্পষ্ট। অপর এক স্থানে ধর্মীয় স্বাধীনতার ঘোষণা এ ভাষায় করা হয়েছে যে, তুমি বলে দাও, এই সত্য তোমাদের প্রভু প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব, যার ইচ্ছা এতে ইমান আনুক যার ইচ্ছা অস্বীকার করুক (সূরা কাহফ)।

পবিত্র কুরআনের ভিত্তিতে গড়ে উঠা সমাজ জাতীয় শান্তি ও নিরাপত্তার জামিনদার হয়ে যায় এবং অবশেষে যদি বিশ্বের সব রাষ্ট্র নিজ নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এসব মূলনীতিতে সংঘবদ্ধ হয়ে যায় এবং কুরআনি শিক্ষামালাকে পথ নির্দেশক বানিয়ে এসব মূলনীতি বাস্তবায়ন করে তাহলে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায়, বিশ্বশান্তি পুরো বিশ্বের ভাগ্যে অবশ্যই জুটবে। তাই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে পবিত্র কুরআনের শিক্ষার ওপর আমল করতে হবে।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

masumon83@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *