ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ধর্ষণের শিকার মেয়েশিশুটিছবি: মানসুরা হোসাইন
লিকলিকে শরীরের নয় বছর বয়সী মেয়েশিশুটির হাতে ক্যানুলা লাগানো। স্যালাইন চলছে।
প্রস্রাব করার জন্য লাগানো আছে ক্যাথেটার। আর তার পেট কেটে সেখানে আলাদাভাবে মল বের করার রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। সেখান দিয়েই মল বের করে তা পরিষ্কার করে দিতে হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মেয়েশিশুটিকে এ অবস্থায় দেখা যায়। পরিবার জানায়, মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেন, ধর্ষণের কারণে মেয়েটির মলত্যাগ ও মাসিকের রাস্তা এক হয়ে গিয়েছিল। এখন তাঁরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা মেরামত করার চেষ্টা করছেন।
এই প্রতিবেদক যখন হাসপাতালে যান, তখন মেয়েটি পা বাঁকা করে বিছানায় শুয়ে ছিল। একই বিছানায় আরেক শিশুরোগী থাকায় পা সোজা করার উপায় নেই তার।
মেয়েটি বালিশ ছাড়াই শুয়ে ছিল। কারণ হিসেবে হাসপাতালে বালিশ-সংকটের কথা জানা গেল। এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে এক চিকিৎসকের সহায়তায় পরে মেয়েটি একটি বালিশ পায়।
মেয়েটিকে বিধ্বস্ত, ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সে একটু পরপর চোখ বন্ধ করে। চেষ্টা করে ঘুমানোর। কিন্তু ব্যথায় আবার জেগে যায়।
চিকিৎসক-নার্স মেয়েটির কাছে গিয়ে তার আঘাতের জায়গা বা নতুন বানিয়ে দেওয়া পায়খানার রাস্তা দেখতে চাইলে সে ভয়ে আঁতকে ওঠে। কোনোভাবেই হাত দিতে দিচ্ছিল না। পরে নিজেই তাঁদের তা দেখায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ইউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির শারীরিক কষ্ট তো আছেই, সঙ্গে আছে মানসিক আঘাতও (ট্রমা)। মেয়েটি যে ট্রমার মধ্যে আছে, তা নিয়ে তাকে হয়তো জীবনভর ভুগতে হবে।
মেয়েটির বাবা রাজধানীতে রিকশা চালান। মেয়ের এ ঘটনায় তিনি বনানী থানায় ১৪ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০২০-এ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ১২ অক্টোবর রাতে মেয়েটি বাসার কাছে একটি স্থানে গিয়েছিল। ঘরে ফিরে না আসায় মা–বাবা মেয়েকে খুঁজতে বের হন। তাঁরা রাতে মেয়েকে খুঁজে পাননি। পরের দিন সকালে মেয়ে একাই বাসায় ফিরে আসে। তখন মেয়ে জানায়, এক লোক তাকে একটি ব্যাগ দেখে রাখতে বলেছিলেন। পরে লোকটি বলে, ব্যাগটি তার বাসায় পৌঁছে দিলে তাকে ২০০ টাকা দেবেন। তারপর বাসায় নিয়ে লোকটি তাকে ধর্ষণ করেন। পরে লোকটি তাকে বাসায় ফেরার জন্য বাসে তুলে দেন। লোকটি কে, তিনি মেয়েটিকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন, এসব তথ্য সে (মেয়ে) জানাতে পারেনি।
হাসপাতালে মেয়েটির শয্যার পাশে ছিলেন তার মা। আরেকটি শিশুসন্তান তাঁর কোলে। তিনি জানালেন, তাঁদের এই বিপদের সময় পরিচিত কারও কাছ থেকে যদি কিছু টাকাপয়সা ধার পাওয়া যায়, সে জন্য তাঁর স্বামী এখন ঘুরছেন।
এই মা প্রথম আলোকে বলেন, যে এলাকা থেকে তাঁর মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আছেন। তবে তাঁরা এখন যে বাসায় থাকেন, সেখানে উঠেছেন দিন ১৫ আগে। ফলে এলাকা পরিচিত হওয়ায় মেয়ে পরে রাস্তা চিনে ঘরে ফিরতে পেরেছে। সে প্রথমে ভয়ে পরিচিত একজনের বাসায় ছিল। পরে নিজেদের বাসায় আসে।
মা বলেন, মেয়ে বাসায় ফিরলে তাকে টিউবওয়েল চেপে পানি বের করে গোসল করতে বলেন তিনি। তখন দেখা যায়, মেয়ের পা বেয়ে রক্ত পড়ছে। তখন তাঁর সন্দেহ হয়। তিনি মেয়ের কাছে ঘটনা জানতে চান। একপর্যায়ে মেয়ে সব বলে। তারপর তাঁরা থানায় যান। থানা থেকে তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
মেয়েটিকে ১৪ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস (ওসিসি) সেন্টারে ভর্তি করা হয়। ওসিসির সমন্বয়কারী প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সাবিনা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তির পর দেখা যায়, মেয়েটির মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। একই জায়গা দিয়ে মল বের হচ্ছে। পরে তার অস্ত্রোপচার করা হয়। পেটের মধ্যে মল বের করার রাস্তা বানিয়ে দেওয়া হয়। তিন মাস পর তা বন্ধ করে দিয়ে মেয়েটি যাতে স্বাভাবিকভাবে মলত্যাগ করতে পারে, সে চেষ্টা করছেন চিকিৎসকেরা। ভবিষ্যতে মেয়েটি কী কী শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
মেয়েটির ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে বলে জানালেন সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, অন্য যেসব পরীক্ষা আছে, সেগুলো করা হবে মেয়েটি একটু সুস্থ হলে। মেয়েটির পুরোপুরি সুস্থ হতে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হবে।
মেয়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মা জানালেন, তাঁর বিয়ের ১২ বছর পর এই সন্তানের (মেয়ে) জন্ম হয়। সে খুব আদরের মেয়ে। বলতে গেলে কোলে কোলে রেখে মেয়েকে বড় করেছেন। সব সময় তার মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিতেন। সেই মেয়ের এই অবস্থা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। মেয়ের শারীরিক যে ক্ষত, তা দেখলে তিনিই ভয় পেয়ে যান।
এই মা বলেন, ‘মাইয়্যা জানাইছে, এক ব্যাডা (পুরুষ ব্যক্তি) তারে ফুসলায়ে তার বাসায় নিয়া গেছিল। তারপর এই ঘটনা ঘটাইছে। মাইয়্যার যে কী ক্ষতি হইল, তা তো বুঝতে পারতেছে না। ব্যাডায় মাইয়্যার সঙ্গে যখন ওই কাম করছে, তহন কি আর মাইয়্যার শইলে জীবনডা ছিল? এইটুকুন একটা মাইয়্যা।’
হাসপাতাল থেকে চলে আসার আগে মেয়েটি অনেকটা নিস্তেজ গলায় বলল, ‘শরীরে কেউ হাত দিলে মনে হয় ব্যথা লাগব। তাই ভয় পাই।’
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাসেল সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণ মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি শনাক্ত ও তাঁকে ধরার জন্য তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেহেদী হাসান বলেন, মেয়েটি খুব ছোট। ঘটনার সময় নিয়ে সে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না। অজ্ঞাতনামা আসামি শনাক্তে তাঁরা আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ যাচাই করছেন। এ জন্য কিছুটা সময় লাগছে।
সেই মেয়েটিকে ডায়াপার পরে থাকতে হয়
২০১৬ সালের অক্টোবরে দিনাজপুরে পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। তার প্রজনন অঙ্গ, মাথা, গলা, হাত ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। ঊরুতে ছিল সিগারেটের ছ্যাঁকার ক্ষত। ঘটনার পর শিশুটি দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। পরে বাড়ি ফেরে। এখন সে স্কুলেও যাচ্ছে।
ধর্ষণের কারণে এই মেয়ের প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা এক হয়ে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত তার তিনটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে মেয়েটিকে এখনো অনিয়ন্ত্রিত প্রস্রাবের জন্য ডায়াপার পরে থাকতে হয় বলে জানালেন তার মা।
মুঠোফোনে কথা হয় মেয়েটির মায়ের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ে স্কুলে গেলে দিনে দুটি ডায়াপার লাগে। ডায়াপারের একেকটি প্যাকেটের দাম ৫৫০ টাকা। ডায়াপার শেষ হয়ে গেলে নতুন করে তা না কেনা পর্যন্ত মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখতে হয়।
২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি এই ধর্ষণ মামলায় মো. সাইফুল ইসলাম (৪২) নামের আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড। মামলায় বেকসুর খালাস পান এক আসামি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেয়েটির ভর্তি থেকে শুরু করে এই ধর্ষণ মামলার রায় হওয়া পর্যন্ত ঘটনাটি নিয়ে প্রথম আলো একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তখন মেয়েটিকে সহযোগিতার জন্য অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন।
মেয়েটির মা প্রথম আলোকে বলেন, এক সময় তাঁর মেয়েকে অনেকেই সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এখন আর কেউ তেমন খোঁজ নেন না। মেয়ের বাবা কষ্ট করে সংসার চালান। অনেক দিন চলে গেল; কিন্তু তাঁর মেয়েটি এখনো সুস্থ হলো না। মেয়ে আগে মানুষ দেখলে ভয় পেত। কিন্তু এখন আর ভয় পায় না। তিনি মেয়েকে সাহস দিয়েছেন। বলেছেন, জীবনে চলতে গেলে ভয় পেলে চলবে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা ধর্ষণের শিকার নয় বছর বয়সী শিশুটির কথা এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে শুনে দিনাজপুরের এই মা বললেন, ‘আমি আমার মেয়ের মামলায় আপস করি নাই। লড়েই গেছি। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় অনেকেই আপস করে ফেলেন। ফলে ধর্ষকেরা কয়দিন জেল খেটে আবার বের হয়ে আসে। এটা দেখে অন্যরা আরও সাহস পায়। ধর্ষকের ফাঁসি হলে এ ধরনের ঘটনা কিছুটা কমত।’